• ৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খরচ বাড়ছে মালিকদের ভেজাল তেলে গাড়ির ক্ষতি

Gagan Alonews
প্রকাশিত অক্টোবর ২২, ২০২৫, ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ
খরচ বাড়ছে মালিকদের ভেজাল তেলে গাড়ির ক্ষতি
সংবাদটি শেয়ার করুন....

নিশান এক্সট্রেইল গাড়ির হাইব্রিড মডেল ব্যবহার করেন সরকারি কর্মকর্তা হাসান মূর্তাজা। সাভার ও আমিনবাজারের দুটি পাম্প থেকে নিয়মিত অকটেন কেনেন তিনি। আগে প্রতি লিটারে ৮-৯ কিলোমিটার মাইলেজ পেতেন। দুই মাস ধরে ৫-৬ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। নিয়মিত গাড়ি পরীক্ষা করান, গাড়িতে কোনো ত্রুটি নেই। তবু মাইলেজ কমে গেছে।

এক লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহার করে একটি গাড়ি বা মোটরসাইকেল যত রাস্তা যায়, সেটিই মাইলেজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাড়ি বা মোটরসাইকেলের ধরন বুঝে মাইলেজ আলাদা হতে পারে। কিন্তু একই গাড়ি বা মোটরসাইকেলের হঠাৎ মাইলেজ কমতে পারে যান্ত্রিক ত্রুটি বা তেলের কারণে। বাজারে নিম্নমানের ভেজাল তেল বেড়েছে। তাই একই পরিমাণ তেলে গাড়ি আগের মতো চলছে না।

নোয়াখালী জেলার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ফখরে আলমের মোটরবাইক চলেছে প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার। এরই মধ্যে বাইকের তেলের ট্যাংকে জং ধরে ছিদ্র হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে বাইকের কার্বোরেটর। তিনি বলেন, ভেজাল তেলের কারণে এমনটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাইকের মেকানিকরা।

নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর বাইক মেকানিক মো. সুমন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বাইকের প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে তেলের ট্যাংক ও কার্বোরেটর। অল্প দিন ব্যবহারের পরই অনেক নতুন বাইকের ট্যাংক ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। অতীতে কখনো এমনটা হয়নি। সুমনের ধারণা, বাজারে যে জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে, ওই সব তেলের মধ্যে হয়তো এমন কোনো কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে, যার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে।

বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান বজায় রেখেই তেল সরবরাহ করা হয়। বিপণনপ্রক্রিয়ার মাঝপথে কোথাও ভেজাল মেশানো হতে পারে বা অবৈধ তেল ঢুকতে পারে। ভেজাল রোধে পেট্রলপাম্পে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। ডিপোতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

কিছু ডিপোয় ভেজাল মিশিয়ে তেল চুরি

দেশে জ্বালানি সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আমদানির পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি তেল পরিশোধনাগার, গ্যাস ফিল্ডের পরিশোধনাগার থেকে তেল সংগ্রহ করে সংস্থাটি। এসব তেল ডিলারদের মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করে বিপিসির অধীন থাকা তিন সরকারি কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। সারা দেশে তেল সরবরাহ করতে তিন কোম্পানির মিলে ৪৭টি ডিপো আছে। এর মধ্যে কিছু ডিপোয় ভেজাল মিশিয়ে তেল চুরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। বেসরকারি পরিশোধনাগার থেকে নিম্নমানের তেল সংগ্রহ করারও অভিযোগ আছে তেল চুরির চক্রের বিরুদ্ধে।

যশোরের সাজেদ রহমান বলেন, ৫০০ টাকায় ৪ দশমিক ২ লিটার অকটেন কিনে বাইকে করে শহরের মধ্যে ১৫০ কিলোমিটার চলাচল করা যেত। এখন একই তেলে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটারের বেশি চলে না।

সমিতির সদস্য পেট্রলপাম্প মালিকেরা মাঝেমধ্যেই ভেজাল তেল নিয়ে অভিযোগ করছেন উল্লেখ করে বাংলাদেশ পেট্রলপাম্প মালিক সমিতির একাংশের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, এসব অভিযোগ বিপিসিকে জানানো হচ্ছে। ডিপো থেকে তেল পরীক্ষা করে নেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা ছিল ১০ বছর আগে, যা করা হয়নি।

সারা দেশে তেল সরবরাহ করতে তিন কোম্পানির মিলে ৪৭টি ডিপো আছে। এর মধ্যে কিছু ডিপোয় ভেজাল মিশিয়ে তেল চুরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। বেসরকারি পরিশোধনাগার থেকে নিম্নমানের তেল সংগ্রহ করারও অভিযোগ আছে তেল চুরির চক্রের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ আছে গ্রাহকদের

জ্বালানি তেল কোম্পানির সূত্র বলছে, এ খাতে তেল চুরি সব সময়ই ছিল। তাপমাত্রার কারণে বৃদ্ধি পাওয়া তেল ও পরিচালন ক্ষতির নামে তেল চুরি হতো। এখন শুরু হয়েছে তেলে ভেজাল মিশিয়ে চুরি করা। এক বছর ধরে এ প্রবণতা বেড়ে গেছে। বাইরে থেকে কম দামের ভেজাল তেল ডিপোতে নিয়ে এসে পেট্রল ও অকটেনের সঙ্গে মেশানো হয়। ভেজাল তেল নিয়ে অভিযোগ আছে গ্রাহকদের। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে পেট্রলপাম্পকে জরিমানা করা হয়। তবে ডিপো থেকে ভেজাল তেলের এ ব্যবসা থামেনি। ডিপোতে অভিযানও হয় না। ডিপো থেকে ভেজাল তেল সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কিছু ট্যাংকার ও পেট্রলপাম্প মালিক জড়িত।

মাঝেমধ্যে পেট্রলপাম্পে অভিযান চালায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এসব অভিযানে মাপে তেল কম দেওয়ার কারণে জরিমানাও করা হয়। তবে তেলের মান পরীক্ষা করা হয় না। পেট্রলপাম্প মালিকেরা বলছেন, তেলের মান পরীক্ষার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি বিএসটিআইয়ের কাছেও থাকে না।

বিএসটিআইয়ের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পেট্রলপাম্প থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে নিম্নমানের তেল পাওয়া গেলে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। জবাবে তারা বলে, ডিপো থেকে এ তেল সংগ্রহ করেছে। যদিও ডিপোতে তেল পরীক্ষা করা হয় না। কেননা দফায় দফায় চিঠি দিলেও তিন তেল কোম্পানির কেউ বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স নেয়নি। যদিও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক।

জ্বালানি তেল কোম্পানির সূত্র বলছে, এ খাতে তেল চুরি সব সময়ই ছিল। তাপমাত্রার কারণে বৃদ্ধি পাওয়া তেল ও পরিচালন ক্ষতির নামে তেল চুরি হতো। এখন শুরু হয়েছে তেলে ভেজাল মিশিয়ে চুরি করা। এক বছর ধরে এ প্রবণতা বেড়ে গেছে।

গাড়ির ট্যাংকে জং ধরছে

ডিপো থেকে সংগ্রহ করা জ্বালানি তেলের মান নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে ১২ অক্টোবর বিপিসিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস, ডিস্ট্রিবিউটরস, এজেন্টস অ্যান্ড পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এতে বলা হয়, তিনটি তেল কোম্পানির মানে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। পেট্রল ও অকটেনের মান খারাপ হওয়ায় মোটরসাইকেল ও গাড়ির ট্যাংকে মরিচা ও জং ধরছে। পাম্পে তেল মজুতের ট্যাংকেও জং ধরছে। সঠিক মাপে তেল দিতে সমস্যা হচ্ছে। তেলের মান ও রঙে পরিবর্তন হচ্ছে।

পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম বলেন, বিএসটিআই এসে পেট্রলপাম্পে জরিমানা করে, তারা ডিপোতে যায় না। অথচ ডিপো থেকে পাতলা তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। এক বছর ধরে তেলের মানে সমস্যা হচ্ছে।

এর আগে নিম্নমানের তেল পাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর পদ্মা তেল কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল পরিবেশক সমিতি। এতে বলা হয়, খুলনার দৌলতপুরে পদ্মার ডিপো থেকে আসা পেট্রল ও অকটেনের গন্ধ তীব্র। মোটরসাইকেল ঠিকমতো মাইলেজ পাচ্ছে না।

মাঝেমধ্যে পেট্রলপাম্পে অভিযান চালায় বিএসটিআই। এসব অভিযানে মাপে তেল কম দেওয়ার কারণে জরিমানাও করা হয়। তবে তেলের মান পরীক্ষা করা হয় না। পেট্রলপাম্প মালিকেরা বলছেন, তেলের মান পরীক্ষার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি বিএসটিআইয়ের কাছেও থাকে না।

বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান বজায় রেখেই তেল সরবরাহ করা হয়। বিপণনপ্রক্রিয়ার মাঝপথে কোথাও ভেজাল মেশানো হতে পারে বা অবৈধ তেল ঢুকতে পারে। ভেজাল রোধে পেট্রলপাম্পে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। ডিপোতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

নিম্নমানের ভেজাল তেল সরবরাহ করে জনগণের সঙ্গে, ভোক্তার সঙ্গে সরকার তামাশা করছে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম।